বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
  • প্রচ্ছদ » ফিচার » আর্থিক সংকট : সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা প্রয়োজন



আর্থিক সংকট : সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা প্রয়োজন


আলোকিত সময় :
11.08.2022

নিরঞ্জন রায়

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট এবং ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

বাংলাদেশ কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলেই দেশের কিছু বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান বা থিংকট্যাংক এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) সরকারকে নানা রকম পরামর্শ ও উপদেশ দিয়ে থাকে। বিদেশি সংস্থাগুলোর পরামর্শ বা সুপারিশ অবশ্য একটু ভিন্ন। কারণ তারা আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মতো আগ বাড়িয়ে সব কিছুতে বক্তব্য দেয় না। তাদের পরামর্শের জায়গা খুবই সুস্পষ্ট ও বিষয়ভিত্তিক।

সাধারণত সরকার যখন তাদের কাছে কোনো রকম সাহায্য-সহযোগিতার জন্য দ্বারস্থ হয়, ঠিক তখনই এই সংস্থাগুলো তাদের পরামর্শ বা শর্তগুলো সরকারের কাছে উপস্থাপন করে এবং সরকার সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এতে সাময়িক কিছু সুবিধা পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী ফল খুব একটা ভালো হয় না। বিশ্বে সৃষ্ট আর্থিক সংকট, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের কিছু বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের আলোচনা বা পরামর্শ দেওয়া এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফের পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে একটা সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। নিজেদের সাময়িক ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েও আমেরিকা ইচ্ছা করেই হার্ড কারেন্সি নীতি অনুসরণ করে, যাতে কিছু দেশ সংকটে পড়ে। আর ঠিক তখনই এই সংকট মোকাবেলায় সরকারকে বিচলিত করে আইএমএফের দিকে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আমাদের দেশের কিছু বিশেষজ্ঞ সংস্থা ব্যাপক আলোচনা শুরু করে এবং সেই সঙ্গে দিতে থাকে নানা রকম উপদেশ ও পরামর্শ। বিষয়গুলো কাকতালীয় হলেও এর মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে, যা হয়তো তথ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে এই যোগসূত্র বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

বর্তমানে আমাদের দেশে যে ডলারসংকট দেখা দিয়েছে, সেখানেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের কারণে আমেরিকার হার্ড কারেন্সি নীতির ফলে আমাদের দেশে দেখা দিয়েছে ডলারসংকট। আর ঠিক তখনই সেসব বিশেষজ্ঞ সংস্থা শুরু করে দেয় আলোচনা এবং নানা রকম পরামর্শ দেওয়ার কাজ। আর সেই সঙ্গে আইএমএফও এগিয়ে আসে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য এবং বাজেট সহযোগিতা প্রদানের জন্য ডলারে ঋণ প্রদান করতে সম্মত হয়। সেই সঙ্গে জুড়ে দেয় কয়েকটি শর্ত, যা হয়তো সরকারকে মানতে হবে। আইএমএফ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার এমন সহযোগিতা খুব ব্যাপক হারে লক্ষ করা গেছে গত শতাব্দীর আশির দশকের সামরিক শাসনের সময় এবং এমনকি নব্বইয়ের দশকেও যখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না এবং উন্নয়ন বাজেটের বৃহৎ অংশের বাস্তবায়ন নির্ভর করত আইএমএফ বা দাতা গোষ্ঠীর ঋণ ও অনুদানের ওপর। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আর সে রকম অবস্থা খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। কারণ বাংলাদেশ সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে এসেছে অনেক আগেই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি এখন বেশ মজবুত এবং উন্নতির সূচকগুলো বেশ অগ্রগামী। বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ এখন বাংলাদেশ। তাই দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশকে আবার আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হলো এবং তাদের প্রদত্ত শর্তও মানতে হয়েছে। কারণ এবারের সংকট বেশ জটিল এবং এর নিয়ন্ত্রণের কোনো কিছুই বাংলাদেশের হাতে নেই। বাংলাদেশের কাছে যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে এবং রিজার্ভের বাইরেও যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জমা আছে, তাতে হয়তো এই মুহূর্তে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ না নিলেও চলত। কিন্তু আশপাশের দু-একটি দেশে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে এবং বিশ্বের সংকট যেভাবে জটিল থেকে আরো জটিল হয়ে উঠছে, তাতে আর্থিক এবং ডলারসংকট যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ আঁচ করতে পারবে না। আর এ কারণেই অধিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকার হয়তো আগেই আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এবারের ডলারসংকট, সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং সার্বিকভাবে যে জটিল অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের ভেতরের বিশেষজ্ঞ সংস্থা এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞ, বিশেষ করে আইএমএফের কাছ থেকে পরামর্শ, উপদেশ ও শর্ত আসবেই। এর অনেক কিছু সরকারকে গ্রহণও হয়তো করতে হবে। তবে এসব বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার আগে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞ অর্থনৈতিক সংস্থা বলে দাবিদার যে প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত সরকারের যেকোনো পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করে এবং উপদেশ দিয়ে থাকে, তাদের কোনো পরামর্শ সরকারের আদৌ বিবেচনা করার প্রয়োজন আছে বলে আমাদের মনে হয় না। কারণ সেই সংস্থা এরই মধ্যে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। যে পেশাদার সংস্থা রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো অনর্গল তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই বলে বেড়ায় যে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, তাদের সেই কথায় আর যা-ই হোক কোনো পেশাদারি যে নেই, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। দেশ থেকে টাকা পাচার নিশ্চয়ই হয় এবং এটিও একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই টাকা পাচারের কোনো সংখ্যা উল্লেখ করতে হলে তার সপক্ষে সঠিক তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে হবে। তা না করে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের ঢালাও বক্তব্য কোনো পেশাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া হয়, তখন তাদের পেশাদারি আর থাকে না। এ ছাড়া পদ্মা সেতু নিয়ে তাদের বক্তব্য ও পরামর্শ যে অসার, তা তো এরই মধ্যে প্রমাণিত। তাই এ রকম বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান এবং সেই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের কোনো আলোচনা বা সুপারিশ সরকারের আমলে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না।

আইএমএফের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরকারকে আইএমএফকে সঙ্গে রাখতেই হবে। বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক, কিন্তু এমন অবস্থানে এখনো যায়নি যে আইএমএফকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে পারবে। শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি দেশ বাদ দিলে অন্য কোনো দেশের পক্ষেই আইএমএফকে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশ যে অবস্থানে উপনীত হয়েছে, তাতে আইএমএফসহ যেকোনো বিশ্ব সংস্থার সঙ্গে দর-কষাকষির যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই আগের মতো আইএমএফ যে সিদ্ধান্ত বা শর্ত দেবে, তা-ই হুবহু মেনে নিতে হবে, তেমন অবস্থানে বাংলাদেশ নেই। এ কারণেই বর্তমান ডলারসংকট সমাধানে যথেষ্ট সতর্কতা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এর কারণ আইএমএফ আমাদের দেশ বা নির্দিষ্ট কোনো দেশের বিষয় নিয়ে যত না কাজ করে, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে বৈশ্বিক একটা লক্ষ্য সামনে রেখে। তাই আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যদি সেই বৈশ্বিক লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হয়, তাহলে তাদের দেওয়া প্রেসক্রিপশন ও শর্ত সেভাবে কাজে আসবে না। এ ছাড়া তাদের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ও প্রেসক্রিপশন একেবারে তাত্ত্বিক এবং উন্নত বিশ্বের পরিবেশে তৈরি, যা আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থায় সেভাবে কাজে না-ও আসতে পারে।

আমাদের দেশের কৃষক জানে কিভাবে ভালো ফসল ফলাতে হয় এবং কিভাবে তা বিক্রি করতে হয়। তাদের যদি উন্নত বিশ্বের কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলা হয়, তাহলে সেটা খুব একটা কাজে আসবে না, তা সে যত মানসম্পন্ন পদ্ধতিই হোক না কেন। এসব কারণেই আইএমএফের সব প্রেসক্রিপশন বা শর্ত সব সময় আমাদের দেশের জন্য ভালো ফল বয়ে আনতে না-ও পারে। আইএমএফের সব কথাই শুনতে হবে, কিন্তু গ্রহণ করতে হবে ততটুকুই, যতটুকু আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদের শাসনামলে যখন মতিয়া চৌধুরী কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, তখন আইএমএফ এক ঋণের শর্ত হিসেবে কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলেছিল। দেশের কৃষি খাতের অবদানের কথা বিবেচনা করে সে সময় আইএমএফের এমন শর্ত গ্রহণ করা হয়নি। সেদিন যদি আইএমএফের শর্ত মেনে কৃষি খাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হতো, তাহলে আমাদের কৃষি খাতের যে অভাবনীয় উন্নতি, তা সম্ভব হতো না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান ডলারসংকট আমাদের সৃষ্ট নয় এবং এই সংকট যে শিগগিরই কেটে যাবে, তেমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। এই সংকটের মধ্যেই পশ্চিমা বিশ্ব মন্দার কবলে পড়ে গেছে এবং এই মন্দাও কতটা দীর্ঘ হয়, তা-ও অনুমান করা কঠিন। তাই এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে এবং বেশ সময় নিয়ে। একদিকে ডলারের ওপর চাপ কমাতে হবে এবং তার পাশাপাশি ডলার সরবরাহ বৃদ্ধির কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে নেই। শুধু তা-ই নয়, প্রতিটি পদক্ষেপের আগে প্রথমে বিবেচনায় নিতে হবে যাতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখা যায়। বিদেশি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এ রকম কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মধ্যেই নিহিত আছে এই সংকট উত্তরণের পথ।

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এশিয়ায় উদীয়মান ব্যাঘ্র খ্যাতি পাওয়া কয়েকটি দেশ মারাত্মক ডলারসংকটে পড়েছিল এবং তখন একমাত্র মালয়েশিয়া সেই সংকট ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছিল। কারণ মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর পূর্বানুমতি ছাড়া দেশের বাইরে একটি ডলারও পাঠানো যাবে না এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর এমন কঠিন সিদ্ধান্তের জন্য আমেরিকাসহ অনেক পশ্চিমা দেশ তীব্র সমালোচনা করেছিল। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদ সেসব সমালোচনাকে পাত্তা দেননি। কারণ আগে দেশ বাঁচাতে হবে, পরে অন্য কিছু। তাই যে সংকট আমরা সৃষ্টি করিনি, যা সমাধানের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই, উল্টো আমরা যে সংকটের শিকার, সেই সংকট মোকাবেলা করতে হবে অনেক কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে এবং সেই পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণেও থাকতে হবে অতি সতর্ক।



এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি