
মোঃ আশরাফুল হক ও জহিরুল ইসলামঃ কালীগঞ্জ :
গাজীপুর জেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট কালীগঞ্জ
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নামেই সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। রোগ নির্ণয়ের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি
এখানে প্রায় সময়ই বিকল থাকে। এছাড়াও ২০ ভাগ পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থাই নেই সরকারি এই
হাসপাতালে। এই সুযোগে হাসপাতালে কর্মরত কিছু অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে হাসপাতালের
ভেতরেই গড়ে উঠেছে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের একটি শক্তিশালী দালাল চক্র।
এই দালাল চক্র প্রকাশ্যেই হাসপাতাল কম্পাউন্ড হতে রোগী ধরে নিয়ে যাচ্ছে আশে পাশে গড়ে উঠা
বেসরকারি ডায়াগনাষ্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষার নামে রোগী ও
স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। প্রায়ই উচ্চমূল্যে টেস্ট করাতে গিয়ে ঔষুধ
কেনার টাকা থাকছে না অনেক রোগীর। টেস্ট বাণিজ্যের নামে রোগী ও তাদের স্বজনদের সর্বশান্ত করার
বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। এ প্রক্রিয়ার সাথে অনেক অসাধু চিকিৎসকও জড়িত রয়েছেন বলে
জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে
চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাহানারা (৪৫) নামে এক সেবাপ্রার্থী মেয়েলী কিছু সমস্যা নিয়ে সরকারী
হাসপাতালের বর্হিবিভাগে ডাক্তার দেখান। চিকিৎসক তার ব্যবস্থাপত্রে ইউরিনসহ বেশ কিছু টেস্ট করতে
বলেন। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই হাসপাতাল কম্পাউন্ডের ভিতরে অবস্থানরত দালাল চক্রের এক সদস্য
চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী রোগীকে ধরে স্থানীয় একটি বেসরকারী ক্লিনিকে নিয়ে যায়। পরে
পরীক্ষা নিরীক্ষা বাবদ ২ হাজার ৪০০ টাকার একটি বিল তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা
নিতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক (৬৫) বলেন, ডাক্তারের ব্যবহার খুবই খারাপ। নরেশ নামে অপর এক
সেবাপ্রার্থী বলেন, ডাক্তার যেই পরিমান টেষ্ট দিছে, টেষ্ট করব কি দিয়া আর ঔষধই কিনব কি দিয়া
বুঝতে পারতাছি না।
সরেজমিনে জানা গেছে বিভিন্ন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের অন্তত ১০ জন দালাল হাসপাতাল কম্পাউন্ডে
দায়িত্ব পালন করেন। তারা ঘুরে ঘুরে রোগীর নিকট হতে চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে নেয়। তাতে টেস্ট
করানোর নির্দেশনা থাকলেই স্বজনদের ফুঁসলিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে নিয়ে যান। আবার অনেক
চিকিৎসক বেসরকারী কোন ক্লিনিক থেকে টেস্ট করাতে হবে তা সরাসরি রোগী বা তার স্বজনদের বলে
দেন। একটি সূত্র জানায়, চিকিৎসকরা অর্থের লোভে টেস্ট বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। চিকিৎসকরা
জড়িত থাকায় এই চক্রের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে হাসপাতালের অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রকাশ্যে
মুখ খুলতে সাহস পান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক বলেন, আগে জনৈক এক চিকিৎসক
বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য বিসমিল্লাহ ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে নিয়মিত রোগী পাঠাতেন আর এখন
পাঠায় শাপলা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। অধিক লাভের আশায় অনেক চিকিৎসক নিজেদের পরিচয় ভুলে
গিয়ে ব্যবসায়ীদের মতো যা খুশি তাই করছেন। তাদের কারসাজিতেই হাসপাতালের প্যাথলজি ল্যাবে
দুয়েকটি টেষ্ট ছাড়া সব ধরনের টেষ্ট বাইরে থেকে করাতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, সরকারি হাসপাতালের ২০০ গজের মধ্যে কোনো বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার
স্থাপন করা যাবে না, এমন একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু রহস্যজনক
কারণে সেই উদ্যোগ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
এলাকার ২০০ গজেরও কম দূরত্বে গড়ে উঠেছে বিসমিল্লাহ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, আবেশমনি
ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, নয়ন কুমার চাকির নিজস্ব নাম বিহীন মেডিকেল সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানের
সেবা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। এদের এজেন্ট, দালালরা সরকারী হাসপাতালের রোগীদের টেস্ট বাণিজ্য
এবং রোগী ভাগানোর কাজ করে থাকে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সন্নিকটে নয়ন কুমার চাকি নামে এক ব্যাক্তি এমবিবিএস ডাক্তার পরিচয়ে
ক্লিনিক খুলে প্রায় এক যুগ যাবৎ অপচিকিৎসা ও টেষ্ট বাণিজ্য করে আসছিল। সে এলাকা ভিত্তিক
দালাল নিয়োগের মাধ্যমে তার ক্লিনিক ব্যবসার প্রসার ঘটায়। সম্প্রতি তার ব্যবহার ও চিকিৎসাসেবা
নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের সন্দেহ হলে তাঁরা বিষয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা
কর্মকর্তা ডাঃ মনজুর-ই-এলাহীকে অবগত করেন। তিনি বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নয়ন কুমার চাকিকে
এমবিবিএস ও বিএমডিসি সনদপত্র এবং ক্লিনিকের যাবতীয় কাগজপত্রসহ দেখা করার নির্দেশ প্রদান
করলে সে তল্পিতল্পা নিয়ে রাতের আধারে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মনজুর-ই-এলাহী প্রতিবেদককে জানান,
বেশীর ভাগ পরীক্ষা হাসপাতালেই হয়। আমি হাসপাতালের সকল ডাক্তারদের সতর্ক করে জানিয়ে দিব যেন
কোন রোগীকে অপ্রয়োজনীয় টেষ্ট দিয়ে হয়রানী করা না হয়। রোগীরা যেন খালী পকেটে এসে স্বাস্থ্য
সেবা নিয়ে হাসি মুখে ঘরে ফিরে যায়। দালাল চক্র যেন হাসপাতালে না আসতে পারে সে ব্যাপারে কঠোর
ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এছাড়া নাম সর্বস্ব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে মোবাইল কোর্ট
পরিচালনাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি। নয়ন কুমার চাকির এমবিবিএস ও বিএমডিসি সনদপত্র
এবং ক্লিনিকের কাগজপত্রসহ সঠিক ছিল না বলেই সে রাতের আধারে গোাপনে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে
গেছে।
অস্বাভাবিক টেষ্ট, দালাল চক্রের দৌরাত্ব ও নাম বিহীন মেডিকেল সেন্টারের ব্যাপারে জানতে চাইলে
গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ খায়রুজ্জামান জানান, আপনি কি ডাক্তার? ডাক্তার যে টেষ্ট দিবে
তা ডাক্তারই বুঝবে। তবে, যেহেতু আপনি জানিয়েছেন তাই আমি হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সাথে
আলাপ করব এবং রোগীদের কাছ থেকে কেউ যদি আমার কাছে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করে অবশ্যই তা
খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিব।