
ড. আতিউর রহমান ,
আলোকিত সময় ডেস্ক :
সব বিচারেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অতুলনীয় এক দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক। ছিলেন তিনি শান্তির সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। তাই ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক জেমস মেনর বঙ্গবন্ধু বিষয়ে ২০১৮ সালের এক বক্তব্যে অন্য অনেক দেশের জাতির পিতার তুলনায় বঙ্গবন্ধু কেন আলাদা, এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক নেতৃত্বের বেশকিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছিলেন। তার মতে প্রথমত, উৎসের বিচারে বঙ্গবন্ধু একেবারেই এলিট বা অভিজন ছিলেন না। ছিলেন তিনি গ্রাম থেকে উঠে আসা মাটিঘেঁষা একজন মানবিক নেতা। দ্বিতীয়ত, তিনি মোটেও ‘এথনিক ন্যাশনালিস্ট’ ছিলেন না; বরং নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে পুরো একটি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার দিকেই ছিল তার পূর্ণ মনোযোগ। তৃতীয়ত, আবেগতাড়িত হয়ে তিনি নিজে কখনো সিদ্ধান্ত নিতেন না এবং অন্যদেরও অহেতুক উসকে দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। সব সময়ই তিনি আগে আলাপ-আলোচনা করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজেছেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের এমন নান্দনিক অনন্যতা নিয়ে আরও অনেকেই এখন আলোচনা করছেন। তবে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেই আমরা এ বঙ্গবন্ধুকে বেশি করে খুঁজে পাই। এ মহাকাব্যিক ভাষণেই বঙ্গবন্ধুর মানবিক চরিত্র ও তার চিন্তা-দর্শনের মহত্ত্ব এবং অনন্যতা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
৭ মার্চের ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুকে ‘ভায়েরা আমার’ বলে সমবেত মুক্তিকামী জনতাকে সম্বোধন করতে শুনি। এমন করে জনগণকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করা তো জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিতে বিরল নয়। কিন্তু যখন বঙ্গবন্ধু নিপীড়িত মানুষকে ‘ভাই’ বলেন, তখন সেটিকে জনতুষ্টিবাদের অপবাদ দেওয়া যায় না। কেননা আসলেই তো তিনি জনগণের কাতার থেকে উঠে আসা নেতা। ছোটবেলা থেকে তিনি গ্রামবাংলার মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য উদগ্রীব হয়ে কাজ করেছেন। টাকার অভাবে কষ্ট পাওয়া শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করেছেন যখন তিনি নিজেই স্কুলে পড়েন। মানুষের কষ্ট লাঘব আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেই তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। কলেজজীবনে দুর্ভিক্ষে কষ্ট পাওয়া মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে প্রাণপাত করে স্বেচ্ছাসেবা দিয়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এ দেশের কৃষক, শ্রমিক আর মেহনতি বঞ্চিত মানুষের জন্য রাজনীতি করে গেছেন। বারবার কারা নির্যাতিত হয়েছেন। কখনো নীতির প্রশ্নে আপস করেননি, এমনকি ক্ষমতা আর পদের মোহেও কখনো জনস্বার্থের প্রশ্নে পিছু হটেননি। তিনি ছিলেন সত্যিই এ বাংলার বঞ্চিত অভাজনদের অভিভাবক। তাই তার মুখে ‘ভায়েরা আমার’ এ দেশের অভাজনদের মনে অতুলনীয় অনুরণন তৈরি করেছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে। আর এ কারণেই সেদিন রাজনীতির এ অমর কবি সত্যিকার অর্থেই ‘তাদের একজন’-এ রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন।
একইভাবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শনের উদারনৈতিক চরিত্রও এই ঐতিহাসিক ভাষণে বারবার ফুটে উঠতে দেখি। শুরুতে যেমন মুক্তিকামী বাঙালিকে ‘ভাই’ বলেছেন, ভাষণের একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের সম্পর্কেও বলেছেন, ‘তারা আমাদের ভাই’। এর আগে পাকিস্তানি অপশাসনের ২৩ বছরকে ‘মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস’ বলেছেন। তবুও পাকিস্তানিদের প্রতি কোনো জাতিবিদ্বেষ তিনি প্রকাশ করেননি। শুধু তা-ই নয়, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ের পর তিনি তখন কেবল বাংলা নয়; পুরো পাকিস্তানেরই নেতা। যে বোঝাপড়া তিনি পাকিস্তানের এলিটদের সঙ্গে তখন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তার নিজের ভাষাতে তা ছিল ‘শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে। তাই আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক এ মহান নেতা বলতে পেরেছিলেন যদি একজন সাংবিধানিক সংসদ সদস্যও উপযুক্ত ভিন্নমত দেন, তা হলে সেটি তিনি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। বাঙালির আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে জাতিগত সংঘাতের চেহারা দেওয়ার কোনো সুযোগ তিনি রাখেননি। এর আগে সারাজীবন ধরে তিনি যে অন্তর্ভুক্তিমূলক জনগণমুখী রাজনীতি করে এসেছেন, এ ভাষণের পরতে পরতে ওই উদারনীতির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন খুবই স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে। তাই উদারনৈতিক ভাবনার এমন কৃত্রিমতাবিবর্জিত সজীব বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও ৭ মার্চের ভাষণ আলাদা মূল্যায়নের দাবি রাখে।
এ দেশের মানুষের মুক্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো আবেগ আর কারও মনে কাজ করেনি। তাই বলে কখনই তিনি মাথা গরম করে সিদ্ধান্ত নেননি। জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছেন সব সময়। তবে কখনই উসকানি দিয়ে অবিবেচকের মতো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেননি। তার এই ঠাণ্ডা মাথায় কল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতাও দেখতে পাই ৭ মার্চের ভাষণে। সেদিন অনেকেই আশা কিংবা আশঙ্কা করছিলেন, রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বসবেন। আবেগী উৎসুক নেতাকর্মীদের অনেকে হয়তো সেটিই চাইছিলেন। তার দলের তরুণ নেতা ও কর্মীরাদের অনেকেই তেমনটি প্রত্যাশা করেছিলেন। এ জন্য চাপও সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন, এমন ঘোষণা দিলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ওই ময়দানেই আকাশ থেকে বোমা ফেলে অগুণতি মানুষ মারতে শুরু করত। এ কারণে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তাই বলে মানুষকে আপসের পথে যাওয়ার কথাও বলেননি; বরং ‘ঘরে ঘরে দুর্গ’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা রণকৌশল সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন। একই সঙ্গে বলেছেন আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা।
দেখা যাচ্ছে অধ্যাপক মেনর বঙ্গবন্ধুর যে অনন্য বৈশিষ্টগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে সেগুলো চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুর আগাম বার্তা ও নির্দেশনা হিসেবে ঐতিহাসিক গুরুত্বের দাবিদার। আর এখন তো এটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ’ হিসেবে পুরো বিশ্ব ইতিহাসেই এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। আমার মতে, বিশ্ব ইতিহাসের মহানায়কদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অনন্যতার প্রামাণ্য দলিল হিসেবেও এ ভাষণটি আলাদা পাঠের দাবি রাখে। এর প্রতিটি শব্দ তার অন্তরের গভীর বিশ্বাস থেকে আবেগঘন ভাষায় উচ্চারিত হয়েছিল। তাই তো এখনো ভাষণটি সমানভাবে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী প্রায় দুই যুগ ধরে বঙ্গবন্ধু যে দর্শনের বাস্তবমুখী অনুশীলন করেছিলেন তার মূল কথা হলো মাটিঘেঁষা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাস্তবমুখী রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ৭ মার্চের ভাষণে ওই কথাগুলোই খুব অল্প কথায় আর খুব সহজে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন এ দেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে। তবে এখানেই শেষ নয়; বরং এর পর এ দেশকে তিনি কোন পথে এগিয়ে নিতে চান, ওই নির্দেশনাও এ ভাষণে দেখতে পাই। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ এটি নিছক বক্তব্যের কথা ছিল না। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সত্যিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন, এ সাত কোটি মানুষের ‘আত্মশক্তি’র ওপর ভরসা রেখে কী করে শূন্য থেকে শুরু করে একটি দেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দেওয়া যায়। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসন আমলে বঙ্গবন্ধু এ দেশের মাথাপিছু আয়কে মাত্র ৯৩ থেকে ২৭৩ ডলারে নিয়ে গিয়েছিলেন। খাদ্য সহায়তা নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটকৌশল, বৈরী প্রকৃতি কোনো কিছুই বঙ্গবন্ধুর সাত কোটি মানুষকে ‘দাবিয়ে রাখতে’ পারেনি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল তর তর করে তার বিচক্ষণ নেতৃত্বে।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালির দাবি পাকিস্তানিরা না মানলে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবে, এর রূপরেখাও বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ না করলেও এর পর বাংলাদেশের প্রশাসন চলেছে তারই নির্দেশমতো। সত্যি সত্যিই তিনি হতে পেরেছিলেন ‘মুকুটহীন সম্রাট’। তিনি বলেছিলেনÑ জনগণের দাবি তখনকার সরকার যদি না মানে, তা হলে ‘ট্যাক্স বন্ধ’ হবে। কেননা সরকারকে জনগণ কর দেয় সরকারের তরফ থেকে সেবা পাওয়ার জন্য। স্বাধীন দেশে নিজে যখন সরকারপ্রধান হয়েছিলেন, তখনো তিনি এই দর্শন থেকে সরে আসেননি। তাই মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে বারবার তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এই কর্মকর্তাদের বেতন হয় জনগণের করের টাকায়। একইভাবে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে দেখি ‘গ্রামে-মহল্লায়-ইউনিয়নে’ সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার আহ্বান করতে। কারণ তিনি জানতেন কেন্দ্রমুখিতা নয়, বরং বিকেন্দ্রায়নই জনগণের মুক্তির টেকসই পথ। তাই স্বাধীনতার পর তিনি বিকেন্দ্রায়িত সরকারের বিষয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন। তার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর প্রস্তাবনায় দুর্নীতি মোকাবিলা এবং দ্রুত অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রধান কৌশল হিসেবেই ছিল বিকেন্দ্রায়িত ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা।
বঙ্গবন্ধু বিশ্ব ইতিহাসে চিরজাগরূক থাকবেন নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দিশারি হিসেবে। একইভাবে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আবেদনও কখনো ফুরাবে না। এর নির্দেশনা আমাদের এতকাল পথ দেখিয়েছে, আগামীতেও দেখাবে। আমাদের সামনে আজও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের সুরক্ষার প্রশ্ন, অন্ধকারমুখী মৌলবাদী রাজনীতির হুমকি আর হঠকারী আবেগতাড়িত জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির বিপদগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুর অভাজনমুখী, উদারনৈতিক ও বাস্তববাদী দর্শনের সবচেয়ে প্রাঞ্জল দলিল হিসেবে এ ঐতিহাসিক ভাষণ আজও একই রকম প্রাসঙ্গিক। এই ভাষণের মানবিক, শান্তিকামী ও আত্মশক্তির স্পিরিটই যেন হয় আগামী দিনের চলার পথের পাথেয় এ প্রত্যাশাই করি। এ চেতনার আলোকেই তার সৃষ্ট বাংলাদেশে প্রতিদিন রচিত হোক ‘শেখ মুজিব নামের নতুন কবিতা।’
ড. আতিউর রহমান : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর